একটি ভাগ্য বদলের গল্প:
সৌদির আজুয়া খেজুর বাগান বাংলাদেশে
পরিশ্রম ও ইচ্ছা থাকলে মানুষ যে তার ভাগ্য বদলাতে পারে, তা চিরকাল সত্য বলে প্রমানীত হয়েছে । আজো প্রমানীত হয়েছে, ময়মনসিংহ জেলার, ভালুকার, নামাপাড়া গাঁয়ের মোতালেব এর বেলায় । মোতালেব ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমান সৌদি আরবে । স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা সবার ভালোবাসা ছেড়ে সৌদি আরবের মরুভূমির প্রচন্ড গরমে কাজ করতে থাকেন এক খেজুর বাগানে । মরুভূমির প্রচন্ড গরমে মোতালেব মাঝে মধ্যে খুবই কষ্ট পেতেন । তবুও দেশের ভালোবাসা আর ভাগ্যবদলের স্বপ্ন তাকে সেখানে থাকতে বাধ্য করেন । খেজুর বাগানে কাজ করতে থাকেন টানা তিন বছর । কাজ করতে করতে এক সময় খেজুর বাগান পরিচর্যার সমস্ত নিয়ম কানুন শিখে ফেলেন । দীর্ঘ দিন কাজ করার ফলে বাগান মালিকের সাথে মোতালেবের একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেন । সে স্বপ্ন দেখতে থাকেন, কিভাবে দেশের মাটিতে একটি সৌদি খেজুরের বাগান করা যায় । একদিন বাগান মালিককে বলেন, তিনি তার কাছ থেকে কিছু খেজুরের বীজ সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে যেতে চান । বাগান মালিকও সুযোগ পেয়ে একটি কঠিন শর্ত জুড়ে দেন । মোতালেব চিন্তায় পড়ে যান এবং বিষয়টি নিয়ে অনেক ভাবতে থাকেন । শেষ পর্যন্ত বাগান মালিককে ছয় মাসের বেতন বাবদ, তিন হাজার ছয়শত রিয়েলের বিনিময়ে কিছু আজুয়া খেজুরের বীজ সংগ্রহ করে, ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেন ।
বীজ গুলো লাগানোর জন্য, একটি জায়গা নির্ধারন করে বীজ গুলো রোপন করেন । এক মাস যাবার পর বীজ থেকে চারা গজাতে শুরু করেন । মোতালেবের আনন্দে মন ভরে যায় । ছল ছল চোখে গাছের চারা গুলো দেখতে থাকেন । সে ভাবতে থাকেন তার স্বপ্ন হয়তো সত্যি হতে চলছে । মোতালেব সিদ্ধান্ত নেন, সে আর সৌদি ফিরে যাবেন না । সে চারা গাছ গুলোর পরিচর্যা করতে থাকেন । গাছ গুলো দিন দিন বড় হতে থাকে । জীবন ও স্বপ্নের কাছে যেন সব কিছুই বাজী ধরেছেন মোতালেব । কিছুই চায় না সে । শুধুই তার স্বপ্ন, এদেশের মাটিতে একটি সৌদি খেজুরের বাগান । প্রতিবেশীদের বিভিন্ন ধরনের নিরুৎসাহেও তার মন ভাঙ্গেনি, তার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন । গাছ বড় হয়ে ফুল ধরতে শুরু করেন ।
মোতালেব অত্যান্ত আনন্দের সাথে কাজ করতে থাকেন । প্রতিবেশী শত্রুরা তার গাছের ফুল গুলো রাতের অাঁধারে কেটে, সেচ পাম্পটিও চুরি করে নিয়ে যায় । সেই সাথে অনেক গুলো গাছও কেটে ফেলা হয় । তবুও তার মন ভাঙ্গে না, তার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন । মোতালেব খেজুর বাগান বাঁচাতে পাহারা দেবার জন্য বাগানের ভিতর, এটি উঁচু কুঁড়ে ঘর নির্মান করে পাহারা দেওয়া অব্যাহত রাখেন । প্রতিবেশী শত্রুরা বারবার বাগান ধ্বংশের চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন । এতো বাঁধা সত্ত্বেও সে হাল ছাড়েননি, বরং তার স্বপ্নের দানা আরো বাড়তে থাকে । ২০০৬ সালে বাগানের খেজুর গাছ গুলোতে রিষ্ট-পুষ্ট বড় বড় খেজুর ধরতে শুরু করে । মোতালেবের মুখে আনন্দের হাসি । শত্রুরা তার কাছে পরাজিত হয় । একের পর এক, খেজুর গাছে ফল ধরতে শুরু করে । এই খেজুর জাতের নাম “আজুয়া” । আমাদের মহানবী এই জাতের খেজুরের বাগান লাগিয়ে ছিলেন । মোতালেব তার আস্থায় অবিচল ছিলেন বলেই তার সফলতা আসেন । ২০০১ সালে এই বাগানের যাত্রা শুরু করে এবং ২০০৬ সালে ফল ধরতে শুরু করে । ২০১২ সালে এসে মোতালেব একজন সফল “সৌদি খেজুর চাষি” । ২০১৮ সালে এসে, সে তার ভাগ্য পুরোপুরি বদলিয়েছে । বদলিয়েছে তার আর্থিক অবস্থা ।
মোতালেবের বাগানের প্রতিটি সাধারণ চারার মূল্য ২০০ টাকা । কিছু চারা রয়েছে যা সরাসরি গাছ থেকে শাখা বের হয়ে তৈরী হয় । এধরনের একেকটি চারার মূল্য এক লক্ষ থেকে চার/পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে । খেজুরের চারার গুনগত মানের উপরই চারার দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে । কাঁচা আজুয়া খেজুর, বাগান থেকেই তিন হাজার টাকা দরে মানুষ কিনে নিয়ে যান । মোতালেবের আজুয়া খেজুর চাষ বাংলাদেশের জন্য এক বিষ্ময় । তার খেজুরের বাগান ছিল অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো । প্রবাদ আছে, “পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি” । সেটাই আজ প্রমানিত হলো । মোতালেবের হাত ধরেই ছড়িয়ে পড়ুক “সৌদি খেজুরের বাগান” বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে । এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।