সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমন,
কিভাবে যাবেন ও কত খরচ হবে
আমাদের দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন । এখানে রয়েছে বিশাল ও বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য । এখানে গেলে যে কোনো মানুষেরই মন ভালো হয়ে যায় । সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ ও বড় বড় প্রবাল দেখলে ভাঙ্গা মনও জোড়া লেগে যায় । একদিকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে নারিকেল বাগান ও অন্যদিকে বড়
বড় প্রবালের উপর সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ । এ যেন প্রকৃতির এক বিরামহীন খেলা । এই প্রবালদ্বীপ দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমায় বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনে । আমরা এই সেন্টমার্টিন নিয়ে আজকের প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানাবো, কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, কি খাবেন, তার প্রাইজ কেমন । হোটেলে থাকলে তার ভাড়া কত, আপনার আসা যাওয়া সমস্ত খরচ ইত্যাদি । এ প্রতিবেদনে তুলে ধরব, বিস্তারিত সবকিছুই । আশাকরি, পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে উপকৃত হতে পারবেন ।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত, একটি প্রবাল দ্বীপ । এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মায়ানমারের উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত । এই প্রবালদ্বীপে যেতে হলে, টেকনাফ থেকে জাহাজ, ট্রলার বা স্পিডবোট দিয়ে যেতে হবে । অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত, এই পাঁচ মাস সাধারণত সেন্টমার্টিন ভ্রমণের উপযুক্ত সময় । দুই রাতের ট্যুর প্ল্যান করবেন, কারণ প্রথম দিন যেতে যেতেই দুপুর হয়ে যাবে । তড়িঘড়ি করে বিকালটা ঘুরে, পরদিন আবার ফেরত আসতে নিশ্চয়ই আপনার মন চাইবে না । দুই রাত প্ল্যান করে আসলে আপনাদের জন্য ভ্রমণটা ফলপ্রসূ হবে, ভালো লাগবে । ধীরে সুস্থে পুরোটা সময় ঘুরে বেড়িয়ে যেতে পারবেন, এই প্রবাল দ্বীপ থেকে । এই প্রবাল দ্বীপের সৌন্দর্য এতটাই মনমুগ্ধকর, আপনি ওখানে গেলে ফিরে আসতে চাইবেন না । একা বা বন্ধুদের সাথে নিয়ে গেলে, সম্ভব হলে হাতে একটু সময় নিয়ে যাবেন । পরিবারের সাথে গেলে অন্তত ২ থেকে ৩ দিন হাতে নিয়ে যাবেন । তাই আস্তে ধীরে সবাইকে নিয়ে পুরো প্রবালদ্বীপ,
ঘুরে বেড়িয়ে আসতে পারবেন ।
কিভাবে যাবেন সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে । ঢাকা থেকে শ্যামলী, হানিফ, সেন্টমার্টিন পরিবহন সহ বেশ কয়েকটি বাস চলে ওই রোডে । নিজের পছন্দমত বাস নির্বাচন করে, এক সপ্তাহ বা দশ দিন আগেই টিকিট কেটে রাখুন । কারণ এই সময়ে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে । সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটায় গাড়ির টিকেট সংগ্রহ করুন । কারণ পরদিন সকাল ৯ টায় সেন্টমার্টিন যাওয়ার জাহাজ ধরতে হবে । সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে সাগরের ঢেউয়ের দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন । পাশাপাশি অনেক পাখি উড়বে, যা দেখে আপনার মনে থাকবে সারা জীবন । এই ধরনের নৈসর্গিক দৃশ্য আপনি সহজে কোথাও পাবেন না, যা সেন্টমার্টিনে রয়েছে । আপনার ওঠা জাহাজটি যখন নাফ নদী পার হয়ে বঙ্গোপসাগরে ঢুকবে । বড় বড় ঢেউ যখন জাহাজটি দুলতে শুরু করবে, তখন আপনার মনে হবে, এই বুঝি জাহাজটি ডুবে যাবে । আপনি একটুও ভয় পাবেন না । কারণ এই ঢেউয়ের ভিতরেই জাহাজটি প্রতিনিয়ত চলে মানুষ পারাপার করে, কখনোই ডুবে না । জাহাজের কারিগরি কৌশল গুলো বড় বড় ঢেউয়ে চলার উপযোগী করেই তৈরি করা হয়েছে ।
সেন্টমার্টিনে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় । প্রতি ঘন্টা সাইকেল ভাড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে । তিন ঘণ্টায় আপনি পুরো সেন্টমাটিন দ্বীপ সাইকেল দিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন । তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোনো কোনো নির্জন জায়গা আছে, যেখানে মানুষ যাতায়াত করেন না । তবে কয়েকজন বন্ধু মিলে সাইকেল নিয়ে, সব জায়গায় নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারবেন । সেন্টমার্টিনের হোটেলগুলোতে আপনি পছন্দ করে মাছ ফ্রাই করে খেতে পারবেন । তবে মসলা মাখানো কাটা মাছগুলো খাবেন না । মসলা মাখানো অধিকাংশ মাছগুলি পঁচা বা বাসি হয়ে থাকে । নিজে পছন্দ করে মাছ কিনে দিবেন । তারা মাছ কেটে সুন্দুর করে ফ্রাই করে দিবে । এতে আপনি ঠকবেন না, বরং ভালো মাছ আপনি পছন্দ করে খেতে পারবেন ।
সেন্টমার্টিন জাহাজ ঘাটে সমুদ্র ভ্রমনের জন্য স্পিটবোট
সেন্টমার্টিন আসলে অবশ্যই একবার ছেঁড়াদ্বীপ যাবেন । সেন্টমার্টিন ১ রাত থেকে, পরদিন সকালে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন । তাই সকালে ফ্রেস হয়ে, নাস্তা সেরেই, চলে আসুন ট্রলার ঘাটে । এখানে আপনি ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার জন্য অনেক গুলো ট্রলার পাবেন । যদি কোনো কারণে ট্রলার না পান, তাহলে স্পিডবোটে করে যেতে পারবেন । তবে স্পিড বোটের ভাড়া কিছুটা বেশি পড়বে । ট্রলারে ছেড়া দ্বীপ আসা এবং যাওয়ার জন্য নেবে জনপ্রতি ১৫০ টাকা করে । আর স্পিড বোটে গেলে, আসা-যাওয়ার জন্য জনপ্রতি নেবে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে । তবে ট্রলারের চাইতে স্পিডবোটে যাওয়া-আসার সময়টা কিছু কম লাগে । এতে আপনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় বেঁচে যাবে । ছেড়া দ্বীপ অনেক সুন্দর একটি জায়গা । এখানে গেলে আপনার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে । পুরো দ্বীপ নির্দিষ্ট দলে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবেন নিরাপদে । তবে মনে রাখবেন, কেটস বা ভালো জুতা ছাড়া, এই দ্বীপে ঘোরাফেরা খুব বিপদজনক হতে পারে । কারণ শামুক-ঝিনুকে আপনার পা কেটে যেতে পারে । এছাড়াও অনেক পাথরগুলোর ধারালো শামুকের মতো মুখ রয়েছে । যেখানে পা রাখলে, আপনার পা ছিলে যেতে পারে ।
কিভাবে হলো এর নামকরণ, তা আমরা এখন জানবো । ছেঁড়া দ্বীপ হলো, বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু । বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে আর কোন ভূখণ্ড নেই । সেন্টমার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে । যে গুলোকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয়ে থাকে, “ছেঁড়াদিয়া় বা সিরাদিয়া” । ছেঁড়া শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন, এই দ্বীপ সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন । সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন থেকে ছেঁড়া দ্বীপ প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ অবস্থিত । দক্ষিণের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে রয়েছে, প্রচুর প্রাকৃতিক পাথর । দ্বীপের প্রায় অর্ধেক, এই জোয়ারের সময় সমুদ্রের নিচে ডুবে যায় । এই এলাকাটি সরকারের ঘোষিত, একটি পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা । ছেঁড়া দ্বীপ এলাকায় ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানায় জমি বেচা-কেনা আইনত নিষেধ । এমনকি কোন প্রকার স্থাপনা নির্মাণও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ।
সেন্টমার্টিনে ৪০/৫০ টাকা ঘন্টায় সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়
ভ্রমণ শেষে সকাল ১০ টা থেকে ১১ টার ভিতরে চলে আসুন ছেঁড়াদ্বীপ ছেড়ে । সেন্টমার্টিন ফিরে হোটেলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিন । তারপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে, দুপুর দুইটা থেকে আড়াইটার ভিতরে চলে আসুন, জাহাজঘাটের আপনার নির্ধারিত জাহাজটিতে । যদিও তিনটার সময় জাহাজ ছেড়ে দেয় সেন্টমার্টিন থেকে । তবে পরিবারের সদস্য থাকলে, একটু আগে আসাই ভালো । কারণ এই সময়টায় প্রচুর ভিড় পোহাতে হয় । ঠিক ৩টায় টেকনাফের উদ্দেশ্যে জাহাজ ছেড়ে দিবে । জাহাজ চলতে চলতে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে, পুনরায় নাফ নদীতে এসে পড়বে । এই নাফনদী ধরে সামনে এগোতে এগোতে চলে আসবে টেকনাফে ।
আপনি টেকনাফ আসার পর, পূর্বে নির্ধারিত বাস অথবা নতুন যে কোন বাসে ফিরে আসুন, ঢাকায় বা অন্য কোন গন্তব্যে বা বাড়িতে । এই দুইদিনের যাত্রা আপনার জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার জন্ম দিবে এবং ভালোলাগার জন্ম দিবে । বুঝতে পারবেন, আমাদের দেশে কত সুন্দর সুন্দর স্থান রয়েছে, যা পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না । নিচে আপনাদের সুবিধার জন্য সেন্টমার্টিনের বাস, জাহাজ ও হোটেলের ফোন নাম্বার দেয়া হলো । পাশাপাশি আপনার দুইদিন এক রাত্র হোটেলে থাকা সহ, কত খরচ হতে পারে, তারও একটি ধারণা দেওয়া হলো । আশাকরি, সেন্টমার্টিন ভ্রমণের এই গাইড, আপনি ও আপনার পরিবারের অনেক কাজে লাগবে ।
এক জনের
সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমন খরচ:
১.
বাস ভাড়া (ঢাকা টু সেন্টমার্টিন)- ৯০০×২=১৮০০ টাকা (যাওয়া ও আসা) ।
২.
টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন জাহাজে ভাড়া-২৫০×২=৫০০ টাকা (সাধারণ সীটে, যাওয়া ও আসা) ।
৩.
সেন্টমার্টিনে হোটেল ভাড়া- ১০০০ টাকা । ( ১ রাত )
৪.
ছেঁড়া দ্বীপের ট্রলার ভাড়া- ১৫০×২=৩০০ টাকা ( যাওয়া ও আসা ) ।
৫.
সেন্টমার্টিনে হোটেলে খাওয়া- ২০০×৩=৬০০ টাকা ( ১ম দিন দুপুর ও রাতে, পর দিন দুপুরে
) ।
৬.
কুমিল্লায় দুই বেলা খাবার- ৩০০×২=৬০০ টাকা ( বাসে যাওয়ার দিন রাতে ও আসার দিন দুপুরে
)
৭.
সকালের নাস্তা (২দিন)- ৫০×২=১০০ টাকা ( টেকনাফ পৌঁছার পর ও আসার দিন সকালে ) ।
৮.
ভ্যান ভাড়া- ১০০×২=২০০ টাকা ( জাহাজ ঘাট থেকে হোটেলে যাওয়া ও আসা )
*****
সর্ব মোট খরচ= ৫১০০ টাকা ( ব্যক্তিগত হাতখরচ বাদে )
সেন্টমার্টিনে
যে সকল হোটেলে রাত্রি যাপন করবেন, তাদের ফোন নাম্বার:
১.
সমুদ্র বিলাস ( হুমায়ুন আহমদের ) : ০১৮১৩০১৯৮৩৯
২.
হোটেল সপ্ন প্রবাল : ০১৮১৪২৭৪৪০৯, ০১৭২২৫৪৫৮৭২ ( সেন্টমার্টিন ),
০২৮৬১১৪২৮, ০১৭১১১১০৯১৯
( ঢাকা )
৩.
কোরাল ভিউ রিসোর্ট : ০১৯৮০০০৪৭৭৭
No comments:
Post a Comment