স্মৃতিময় দিনগুলো:
নানী বাড়ির বালিপাড়া বিল ও আমার মাছধরা
দিনটি ছিল রবিবার । পৌষের ঠিক মাঝামাঝি । নানি আমাকে আদর করে একটি চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন । ভালোবাসায় ভরা চিঠিতে তিনি আমাকে লিখেছিলেন “নাতি তোকে আমি অনেক দিন দেখিনা । তোর মূখটি দেখার জন্য আমার মনটা খা খা করছে । নারিকেল গাছটি ডাবে ভরে গেছে । তুই আসলে গাছ থেকে ডাব পারবো । বাড়ির গোয়াল ঘরের পিছনে যে, ডালিম গাছটি রয়েছে তাতে আটটি ডালিম ধরেছে । আমি কাপড় মুড়িয়ে বেঁধে রেখেছি । লাউয়ের মাচাঁয় বড় বড় লাউ ধরেছে । বিলে সাদা বকের ঝাঁক নেমে বিলকে সাদা করে দেয় । বিলের জমিতে ধান গাছের ফাঁকে ফাঁকে অনেক মাছ পাওয়া যায় । তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় । আমি তোর জন্য অপেক্ষায় রইলাম । তুই এলে শীতের পিঠা বানাব, মুড়ি ভাজব । আমার চিঠি পেয়ে জলদি চলে আসবি । তোর অপেক্ষায় রইলাম” । নানি চিঠি লিখতে পারতো না । পাশের বাড়ির হাদিকুল মামাকে দিয়ে চিঠিটি লিখিয়ে ছিল । হাদিকুল মামা ক্লাশ টুতে পড়ে, জয়বাংলা স্কুলে । ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতের লিখা চিঠি পেয়ে আমিতো মহাখুশি ।
ভাবছি কালই স্কুলে যেয়ে চার দিন ছুটি নিব । আর কালই নানীর বাড়ি রওয়ানা দিব । ছুটি নিতে যেয়ে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন । আমি স্কুল থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি, নানির বাড়ির ধান ক্ষেতে বরশি দিয়ে অনেক মাছ ধরা যায় । হঠাৎ মনে হলো নানীর জন্য কিছু নিয়ে যাই । তাই সেদিন আর নানীর বাড়ি গেলাম না । বরমী বাজারে গিয়ে নানীর জন্য দুই কেজি গুড়, পান, সুপারী ও জর্দ্দা কিনে আনলাম । রাতে সব কিছুই জোগাড় করে রাখলাম । সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে নানীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম । অললী গ্রামের কদমতলী বাজার দিয়ে সোজা উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম । চার হলদী বিলের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় তিন মাইল চলে এলাম । আরো এক মাইল হাঁটলে বালুচরা বিল । তার মাঝখান দিয়ে নানীর বাড়ি পৌঁছতে আরো প্রায় দুই মাইল যেতে হবে । আমি বিলের চার দিকে দেখতে দেখতে সামনে এগুচ্ছি, অনেক দূর দেখা যাচ্ছে । অনেক বড় বিল জুড়ে শুধুই ধান ক্ষেত । সারি সারি ধানগাছ গুলো বাতাসে হেলেদুরে যাচ্ছে । মাঝে মধ্যে সাদা বকের ঝাঁক উড়ে এসে আইলের উপর বসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে । এমন দৃশ্য দেখে আমারও আনন্দ লাগলো । আমি শুধুই হাঁটছি ।
বিলের মাঝখানে একটি হিজল গাছে লতানো ফুল ধরে আছে ।আমাকে আসতে দেখে হিজল গাছের উপর বসে থাকা দুটি পাখি উত্তর দিকে উড়ে গেলো । একটি পানকৌড়ী ও অন্যটি কানীবক । আমি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম । ঝিরঝিরে বাতাসে পরিবেশটা আমার খুব ভালো লাগতে লাগলো । সূর্য মধ্য আকাশে অবস্থান করছে । মাঝেমধ্যে ধানগাছ গড়িয়ে কিছু বাতাস আমার মনে দোলা দিচ্ছে । আমার খুবই ভালো লাগছে । আমার মনে হচ্ছিল সমস্ত সূখ বোধ হয় হিজল গাছের নিচেই অবস্থান করছে । আমি আকাশের দিকে তাকালাম সূর্য একটু একটু করে পশ্চিম আকাশে হেলতে শুরু করে দিয়েছে ।
আমি হাঁটতে হাঁটতে বালুচরা বিল পার হয়ে নানীবাড়ি গিয়ে পৌছলাম । আমি তখন অনেক ক্লান্ত ও বেশ ক্ষুধার্ত । নানীর ঘরে প্রবেশ করতেই নানী আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমাকে তুই ভূলে গেলি” । নানী আবেগ প্রবন হয়ে গেলো আর কিছুই বলতে পারলো না । এক হাতদিয়ে আমাকে ধরে; অন্য হাতে শাড়ীর অাঁচল দিয়ে শুধুই দু‘চোখের পানি মূছেই চলেছেন । আমিও আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না । আমিও নানীকে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলাম । আমি নানীর বড় নাতীন ছিলাম, তাই আদরও একটু বেশীই পেতাম । নানী চোখ মুছতে মুছতে বললো, “আয় খেতে আয়” বলে নানী পাশের ঘরে চলে গেলো ।
আমি চৌকির উপর কাপড়ের বেগটি রেখেই অন্য নানীদের ঘরে প্রবেশ করে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করি । অন্য নানী বলতে এক নানার অনেক বউ এমনটি নয় । অর্থাৎ আমার নানারা ছিল চার ভাই । তারা সবাই এক সাথে একটি বড় বাড়িতে থাকতো । আমার সমবয়সী অনেকগুলো মামা ছিল । আমি কিছুদিন নানার বাড়ি থেকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছিলাম । স্কুলের নাম জয়বাংলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় । তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি । তাই আমার বন্ধুর সংখ্যাও অনেক বেশী ছিল ।
আমি চৌকির উপর কাপড়ের বেগটি রেখেই অন্য নানীদের ঘরে প্রবেশ করে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করি । অন্য নানী বলতে এক নানার অনেক বউ এমনটি নয় । অর্থাৎ আমার নানারা ছিল চার ভাই । তারা সবাই এক সাথে একটি বড় বাড়িতে থাকতো । আমার সমবয়সী অনেকগুলো মামা ছিল । আমি কিছুদিন নানার বাড়ি থেকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছিলাম । স্কুলের নাম জয়বাংলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় । তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি । তাই আমার বন্ধুর সংখ্যাও অনেক বেশী ছিল ।
দুপুরের খাবার শেষ করলাম । খাবার সময় আমার নানী পাশে বসে তালপাখা দিয়ে সারাক্ষণ বাতাস করেছিল । দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে এলো । আমার সমবয়সী মামারা বাড়ি ফিরতে শুরু করলো । কেউ চাষের জমিতে, আবার কেউ স্কুলে ছিল । আমাকে দেখে সবাই খুবই খুশি হলো । বিকালে মামাদের সাথে আড্ডা দিলাম । মনখুলে যত কথা ছিল সব বললাম । সবাই মিলে কবর স্থান মাঠে গোল্লাছুট খেললাম । আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল, আমাদের বয়সী খালারাও । সবাই মাঠে মন ভরে খেললাম । রাতে সব মামারা এক সাথে বাংলো ঘরে পাটি বিছিয়ে ঘুমোলাম । নানার বাড়ির একটা রীতি ছিল । ভোরে মোরগের ডাকের সাথে সাথে সবার ঘুম ভাঙ্গে । কেউ হাত মুখ ঘুয়ে পড়তে বসে, আবার কেউ জমি চাষ করতে যায় । আমি যথারীতি ঘুমিয়েই থাকলাম । বেলা উঠার পর আমার ঘুম ভাঙলো । নানী আমার জন্য খেজুরের রসের ক্ষির রান্না করলো, পিঠা বানালো ।
আমি নাস্তা খেলাম । নানী আমার পাশে বসে থাকলো । নানীর বাড়িতে সবার ঘরেই মাছ ধরার বরশি ছিল । আমি একটি বরশির ছিপ , মাছের খাবারের জন্য কিছু চিংড়ি মাছ ও মাছ ধরে রাখার জন্য একটি ডোলা নিয়ে বিলের দিকে বের হয়ে গেলাম । দুপুরে খাবার সময়টুকু ছাড়া পুরোদিনই বিলে ছিলাম । সে দিন বরশি দিয়ে অনেক মাছ ধরে ছিলাম । ঝিরঝিরে হালকা বাতাসের দোলায় মিশে গিয়েছিলাম ধান গাছের মাঝে । আড্ডা, আনন্দ আর মাছ ধরার মাঝে কখন যে, তিন দিন পার হয়ে গেল, বোঝতেই পারলাম না । আমার স্কুলের ছুটি শেষ হয়ে গেলো ।
সকাল বেলা নানী সহ বাড়ির সকলের মন খারাপ, আমি চলে আসব তাই । নানী মাছ, মুড়ি, নারকেল সহ আরো কি কি জানি দিয়ে বড় একটি পোটলা তৈরী করে; আমার হাতে দিল । বলল, “নে তোর মাকে দিস ” আমি প্রথমে নিতে চাইলাম না । সবার পিড়া-পিড়িতে শেষ পর্যন্ত নিতে হলো । আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম । নানী আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে পুকুর পাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিল । আমার সমবয়সী মামারা বালিপাড়া গ্রাম পর্যন্ত এগিয়ে দিল । বুঝতে পারছিলাম, আমাকে বিদায় দিতে তাদের খুব খারাপ লাগছে । আমারও খুব লাগছিল, কেউ কাউকে বুঝতে না দিলেও চেহারায় তা প্রকাশ পাচ্ছিল । হাঁটতে হাঁটতে আমরা বালিপাড়া গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেলাম । সেখানে একটি বড় নিমগাছ ছিল । আমরা সেই নিমগাছের ছায়ায় কতক্ষণ দাঁড়ালাম । গল্প করলাম । মন যেতে চাইছিল না । তার পরও অনেক কষ্টে বিদায় নিলাম । আমি বালুচরা বিলের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকলাম । হাঁটতে হাঁটতে এক সময় চিরচেনা মুখগুলো অদৃশ্য হয়ে হারিয়ে গেল ।